মৌমাছির মত হও।
মৌমাছির মত হও।
আল্লাহ তায়ালা বলেন – وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ – আর তোমার রব মৌমাছিকে আদেশ দিলেনঃ ‘তুমি পাহাড়ে ও গাছে এবং তারা যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে নিবাস বানাও।’ ثُمَّ كُلِي مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا ۚ يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِّلنَّاسِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ – “অতঃপর প্রত্যেক ফল থেকে আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের (শিখানো) সহজ পদ্ধতি অনুসরণ কর। এর পেট থেকে রং-বেরং এর পানীয় বের হয়। এতে মানুষের জন্য আছে আরোগ্য। চিন্তাশীল মানুষের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন আছে।” (16:68-70)
একজন মুসলিমের চিন্তাপদ্ধতি অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। এর কারণ হল আল্লাহর বই। এটা আমাদের চিন্তা ধারাকে রূপদান করে। বস্তুত, আজ আমি আলোচনা শুরু করতে চাই সূরা মূলকের একটি আয়াত দিয়ে। যেখানে বলা হয়েছে – লোকেরা জাহান্নামে প্রবেশ করছে, আর প্রবেশ করা কালে তাদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। তখন, তারা উত্তরে বলবে, وَ قَالُوۡا لَوۡ کُنَّا نَسۡمَعُ اَوۡ نَعۡقِلُ مَا کُنَّا فِیۡۤ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ – বিখ্যাত একটি আয়াত – “এবং তারা বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম…চলুন, এখানে একটু থামি। এখানে কী শুনার কথা বলা হচ্ছে? যদি কুরআন শুনতাম! যদি ইসলামের বার্তা শুনতাম! যদি উপদেশগুলো শুনতাম! এই অংশটি সবাই বুঝে। কিন্তু এরপর আয়াতে ‘ও না’কিলু’ বলা হয়নি, বলা হয়েছেঃ ‘আও না’কিলু’, লাও কুন্না নাস্মাউ’ আও না’কিলু। আর আরবিতে ‘আও’ অর্থঃ অথবা। যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম। অর্থাৎ, যদি শুনতাম অথবা অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনা করতাম।
কথাগুলো এভাবে উপস্থাপনের পেছনে শক্তিশালী উদ্দেশ্য রয়েছে। একদিকে, মুসলমানরা কিছু শুনলে সেখান থেকে শেখার চেষ্টা করবে। আমরা খুৎবা শুনি, রিমাইন্ডার শুনি, লেকচার শুনি, কিছু পড়লেও আমরা ঐখান থেকে শিখি। এগুলো থেকে আমরা উপদেশ গ্রহণ করে থাকি এবং হতে পারে এগুলোর আলোকে নিজের ভালোর জন্য নিজের মাঝে পরিবর্তন আনি। অন্ততপক্ষে, প্রত্যেকের মাঝে পরিবর্তনের চেষ্টা থাকা উচিত।
এই মানুষগুলোর আজ এই পরিণতির অন্যতম একটি কারণ হল, ভালো ভালো উপদেশ শুনার পরেও তারা নিজেদের পরিবর্তন করেনি। তারা শুনতে অস্বীকার করল মানে …শ্রবণ করার দুইটি দিক রয়েছে, একদিকে কিছু কথা কানে প্রবেশ করা আর অন্যদিকে সে কথাগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করা। আরবি ভাষার ক্ষেত্রে একথা যেমন সত্য তেমনি ইংরেজির ক্ষেত্রেও। যেমন, যখন এভাবে বলেন – “আমি তাকে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে শুনেনি।” এর অর্থ এটা নয় যে, সে আমার কথা শুনতে পায়নি, বরং এর অর্থ হল সে আমার কথা অনুযায়ী কাজ করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শ্রবণ করার মাঝে এই দুইটি দিক রয়েছে।
কিন্তু পরের কথাটির উপর আজ আমি জোর দিতে চাই। “অথবা, যদি আমরা চিন্তাভাবনা করতাম।” যদি আমরা নিজেদের বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম। অন্য কথায়, আল্লাহ এই আয়াতে আমাদের বলছেন – এই আয়াতের বাহিরে আরও বহু আয়াতে আমাদের বলছেন – একজন মুসলিমের নিয়মিত চিন্তা করা উচিত। আর তার চিন্তা করার অসংখ্য কারণ রয়েছে; এমনকি যখন সে কোন শায়েখের কাছ থেকে কিছু না শুনে নিভৃতে বসে থাকে তখনো তার চিন্তা করা উচিত। আমরা সর্বদা চিন্তাশীল মানুষ।
তো, যে বিষয়গুলো আমাদের চিন্তাশীল বানায় তা হল আয়াত। আল্লাহর নিদর্শনগুলোর উদ্দেশ্য হল – لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ – “যাতে তারা চিন্তা করে।” (7:176), لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ – “নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে।” (2:164), لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ – “যাতে তোমরা বুঝতে পার।” (12:2) لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ – “যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে” (38:29) যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে।
আর আয়াত বলতে শুধু কুরআনের আয়াত বুঝানো হচ্ছে না বরং আমাদের চারপাশে আল্লাহর যে বিস্ময়কর সৃষ্টি রয়েছে তাও বুঝানো হচ্ছে। যখন বাহিরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকান তখন আপনার এটা নিয়ে চিন্তা করা উচতি। আমরা যখন বাহিরে কোন গাছের দিকে তাকাই তখনও আমাদের চিন্তা করা উচিত। মুসলিমদের তো এটাই করার কথা, সবাই যা দেখে আমরা তা নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করি। তারাও দেখে আর আমরাও দেখি। কিন্তু আমরা যখন দেখি আমরা এর সাথে অন্যকিছুও পর্যবেক্ষণ করি। আমরা চিন্তা করার সুযোগ দেখি, গভীরভাবে অনুধাবন করার সুযোগ দেখি।
————————————————————–
তো, আজকের খুতবাহ এমন একটি বিষয় নিয়ে যা অনেকটা উপেক্ষিত। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা চান আমরা যেন এ সম্পর্কে চিন্তা করি। তিনি চান আমরা যেন ব্যাপারটা গভীরভাবে ভেবে দেখি। এভাবে দুটি বিষয়ের মাঝে পার্থক্য তৈরি হয় – যখন আমরা ভাসা ভাসা কুরআন অধ্যয়ন করি এবং সামনে এগিয়ে যাই, অথবা আমরা থামি এবং আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা কী বলছেন তা গভীরভাবে ভেবে দেখি।
তিনি এই অসাধারণ আয়াতে বলনে – وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ – আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করেন, আপনার রব ওহী অবতীর্ণ করেন…। যখন বলেন – ‘আওহা রাব্বুকা’ কুরআন যেহেতু রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট অবতীর্ণ কালাম, যখন বলা হয় – “আপনার রব অবতীর্ণ করেছেন” রাসূলুল্লাহ (স) যখন এই কথা শুনছেন তিনি হয়তো ভাবছেন আমার রব আমার প্রতি কুরআন নাজিল করেছেন। আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (স) এর প্রতি কুরআন নাজিল করেছেন তাই না? কিন্তু এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন আমি আপনার নিকট অবতীর্ণ হওয়া ওহী সম্পর্কে কথা বলছি না, আমি মৌমাছির নিকট অবতীর্ণ ওহী সম্পর্কে কথা বলছি। যেই প্রভু আপনার নিকট কুরআন অবতীর্ণ করেন তিনিই মৌমাছির প্রতিও কিছু একটা অবতীর্ণ করেন।
ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দেখুন। মৌমাছি আমাদের অধিকাংশের নিকট গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। এমন নয় যে আমরা প্রতিদিন এটা দেখি। যদি দেখেন ভয় পেয়ে তাড়িয়ে দেন।
আর যদি শহরে বাস করেন তাহলে তো আপনি এমনিতেই প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে। মোটের উপর আমরা ইট পাথরের শহরে থাকি, আল্লাহর সৃষ্ট বিস্ময়কর প্রকৃতির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। যে একটি সৃষ্টিকে কখনো এড়ানো যায় না তা হল আকাশ। আকাশ সবসময় উপস্থিত। যারা ব্যস্ত শহরে বাস করেন তাদের এমনকি উপরের দিকে তাকানোরও সময় থাকে না। তারা আশেপাশে তাকান, বাসে যাতায়াত করেন, তারা এমনকি আকাশও দেখেন না। তাহলে আমরা কী নিয়ে ভাববো? আমরা এমনকি নিজেদের জন্য চিন্তা করারও সময় পাই না বা আল্লাহ আমাদের যা নিয়ে চিন্তা করতে বলেন তা নিয়েও ভাববার সময় পাই না।
এই খুৎবাতে আমি আপনাদের এমন জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে বলবো যা আমরা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করি। একটি মৌমাছি। বিশেষ করে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা তাঁর রাসূল (স) কে বলেন এমন এক ধরণের ওহি আছে যা আমি আপনার নিকট অবতীর্ণ করিনি, করেছি মৌমাছির প্রতি। তাই, আমি চাই আপনারা যেন মৌমাছি নিয়ে চিন্তা করেন। সুবহানাল্লাহ!
আমাদেরকে মৌমাছি নিয়ে চিন্তা করতে হবে, কারণ, কুরআনে আল্লাহ যা কিছু বলেছেন সবকিছু আমাদের হেদায়েতের জন্য। তাই, একজন বিশ্বাসী হিসেবে এই ক্ষুদ্র সৃষ্টির প্রতি আমার এখন অন্যরকম একটি শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। কারণ, আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এই ক্ষুদ্র সৃষ্টি আল্লাহর ওহী গ্রহণ করে থাকে। আল্লাহ এমন কথা গরু সম্পর্কে বলেননি, তিনি এমন কথা উট সম্পর্কেও বলেননি, তিনি পাখি সম্বন্ধেও এমনটি বলেননি। ঐ প্রাণীগুলোর কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি করেছেন। তিনি বহু প্রাণীর নাম কুরআনে উল্লেখ করেছেন। অন্য অনেক সৃষ্টির কথা কুরআনে এসেছে।
কিন্তু ওহীর ব্যাপারটি…যা আমাদের মনোযোগকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেন। এই সৃষ্টির মাঝে বিশেষ কিছু রয়েছে যার দরুন আল্লাহ আমাদেরকে এর প্রতি মনোযোগ দিতে বলছেন।
আর এটা একটা ভাবনার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে, যদিও এটা আজকের খুৎবার বিষয় নয়, তবু আপনাদের বলছি – ব্যক্তিগতভাবে কয়েকমাস পূর্বে যখন আমি এই আয়াত নিয়ে গবেষণা করছিলাম, আমি মৌমাছির উপর নির্মিত ৫-৬ টা ডকুমেন্টারি দেখেছি। কারণ, আল্লাহ চান আমরা যেন এই জীবটাকে কদর করি। আল্লাহ একে ওহী দিচ্ছেন। তাই, এই প্রাণীটি যাই করুক না কেন তার সাথে ওহীর একটা সম্পর্ক আছে। এটি ওহী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে। আর এর মাঝে আমাদের জন্য শিক্ষা আছে। আমি মৌমাছি সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। তাই, আমাকে এই বিষয়ে অধ্যয়ন করতে হয়েছিল। আমি এই অধ্যয়নটাকে ইসলামী অধ্যয়ন মনে করি। এটাও কুরআন অধ্যয়ন করার অন্তর্ভুক্ত। ডকুমেন্টারি দেখে দেখে মৌমাছি জীবন প্রণালী শেখা এবং নোট করা আমার জন্য এটা আল্লাহর দ্বীন অধ্যয়ন করার নামান্তর।
কারণ, এই বিষয়টা নিয়ে আল্লাহ আমাদের চিন্তা করতে বলেন। আল্লাহর এই বই থেকে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা অর্জন করতে হলে আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির প্রসারতা থাকাটা জরুরী।
যাই হউক, এই আয়াতে আল্লাহ বলেন – أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا – আল্লাহ মৌমাছির প্রতি ওহী নাজিল করেন ‘ইত্তাখিজি’… এর প্রতি সরাসরি আদেশ। এখানে প্রত্যাশিত ভাষা হওয়ার কথা ছিল – ‘আন তাত্তাখিজা মিনাল জিবালি বুয়ুতান’ “এর বাসা নির্মাণ করা উচিত পাহাড়ে,” وَمِنَ الشَّجَرِ – “ও গাছে” وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ – “এবং তারা যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।” অর্থাৎ মৌচাষীরা এর জন্য যে খাঁচা নির্মাণ করে, যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। অনেক মানুষ মৌচাষ করে। তাহলে মানুষ তাদের জন্য যে খাঁচা তৈরি করে তাতেও এরা বাসা তৈরি করতে পারে।
এখন আমরা এই আয়াত থেকে যা শিখি…প্রথমত, আল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন তিনি মৌমাছিকে সরাসরি আদেশ দিয়ে থাকেন। তিনি এর সাথে সরাসরি কথা বলেন। ‘ইত্তাখিজি’ ব্যাকরণ গত দিক থেকে ‘ফে’লে আমর’ মধ্যম পুরুষে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ সরাসরি মৌমাছির সাথে যোগাযোগ করে বলছেন যে তার কোথায় বাসা বানানো উচিত।
এই আদেশের আরেকটি অসাধারণ উপকার হল, যদি কখনো মধু বা মধু উপজাত কোন দ্রব্য খেয়ে থাকেন…পৃথিবীতে যার বিশাল বাজার রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটা শুধু মধু নয়, অধিকাংশ খামার উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়াতে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঠবাদামের খামার। পৃথিবীর ৯০ ভাগ কাঠবাদাম আসে সেখান থেকে। আর এর সবটা আসে মূলত মৌমাছির সাহায্যে যারা বিভিন্নরকম কাঠবাদামের গাছ থেকে ফুলের রেণু সংগ্রহ করে এবং পরাগায়নে সাহায্য করে। তাই, কৃষকরা সেখানে মৌ চাষ করে। এখন, আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেন তুমি পাহাড়ে বাসা বানাতে পারো, গাছে বাসা বানাতে পারো। কিন্তু আল্লাহ যদি “ওয়া মিম্মা ইয়া’রুশুন” না উল্লেখ করতেন তাহলে আপনারা মৌমাছির বাসা পেতেন শুধু গাছে এবং পাহাড়ে; আমরা কখনই মৌ চাষ করতে পারতাম না। কিন্তু তিনি বলেছেন – “ওয়া মিম্মা ইয়া’রুশুন।” যেন আমি আর আপনি মধু খাওয়ার স্বাদ উপভোগ করতে পারি। কারণ, আল্লাহ একে অনুমতি দিয়েছেন মানুষের তৈরিকৃত বাসায় মৌচাক নির্মাণের যেন আমরা এর চাষ করতে পারি। ব্যাপারটা নিয়ে একবার ভেবে দেখুন।
এই ভাবনা আমাদেরকে এই সত্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে যে, আল্লাহর সৃষ্টি জগত থেকে যত কিছু আমরা উপভোগ করতে পারছি…এর কারণ আল্লাহ এদেরকে সরাসরি আদেশ করেছেন আমাদের সেবা করার জন্য। এই ক্ষেত্রে মৌমাছিকে আদেশ করা হয়েছে আমাদের সেবা করার জন্য। তাই, যখন মানুষ মৌ-বক্স নির্মাণ করে তুমি তাকে নিজের বাসা হিসেবে গ্রহণ করে নাও। একে নিজের বাসা হিসেবে গ্রহণ করে নাও।
কিন্তু আজ আসলে যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই তা হল, এই ক্ষুদ্র সৃষ্টি থেকে কিছু পথনির্দেশনা। শুধু এই সৃষ্টির কদর করা নয়, বরং কিছু হেদায়েত। আর আমি এমন কিছু শিক্ষা এর কাছ থেকে পেয়েছি যা আমাকে সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি করে দিয়েছে। আমি রাসূলুল্লাহ (স) এর একটি হাদিস পেয়েছি – যাকে সহিহ গণ্য করা হয় – “(وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ) আমি সেই সত্ত্বার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ।” আল্লাহর রাসূল (স) কোন শপথ করা ছাড়াই যা ইচ্ছা বলতে পারতেন। কিন্তু, তিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর নামে শপথ করেছেন। কারণ, তিনি এখন যা বলতে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই তা আশ্চর্যজনক কোন বিষয়। তিনি বলেন – “মু’মিনের উদাহরণ হল ঠিক মৌমাছির মত।” আমি বসে থেকে ভাবলাম, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ প্রথমে আমাদের বলেছেন তিনি মৌমাছির প্রতি ওহী প্রেরণ করেন। এখন রাসূলুল্লাহ (স) বলছেন তুমি যদি মুমিন হতে চাও তাহলে ঠিক মৌমাছির মত হও।
মৌমাছির মত হলে কী হবে? আর কীভাবে মৌমাছির মত হব? মৌমাছি আমাকে আমার ঈমান সম্পর্কে কী শেখাবে? কীভাবে একজন বিশ্বাসীর মত বাঁচতে হবে এ ব্যাপারে মৌমাছি কী শেখাবে? ব্যাপারটা এতোই সিরিয়াস যে আল্লাহর রাসূল (স) প্রথমে আল্লাহর নামে শপথ করেছেন তারপর এই কথা বলেছেন। নিশ্চয়ই এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তো, তিনি আমাদের কিছু কথা বললেন যার প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া আরও আছে। কিন্তু, আমি চাই রাসূল (স) কী বলেছেন আপনারা তার প্রতি মনোযোগ প্রদান করুন।
তিনি বলেন – “(আকালাত তায়্যিবান) এটি ভালো জিনিস খায়।” এটি ভালো এবং খাঁটি জিনিস খায়। মৌমাছি উত্তম ফুলের নিকট যায়। এটি এমন কোন ফুলের নিকট থেকে নেয় না যেটি অপরিপক্ব, নষ্ট। এটি এমনকি এমন কোন ফুলের নিকটও যায় না…গন্ধ শুঁকে এটি বুঝে ফেলে অন্য মৌমাছি ইতোমধ্যে এই ফুলের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। এটি নতুন, পরিষ্কার, খাঁটি একটি ফুলের নিকট যায়। এটি শুধু সেই ধরণের ফুলের নিকট যায়।
আমাদের ঈমানের প্রথম যে ব্যাপারটি এখানে হাইলাইট করা হয়েছে তা হল, যে রিজিকের আমরা সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি…শুধু যে খাদ্য আহার কর তাই নয়, বরং যে রিজিকের পিছে ছুটি, যে চাকরি আপনি পাবেন, যে ব্যবসা আপনি শুরু করবেন, যে টাকা আপনি কামাবেন, এবং যে খাদ্য আপনি আহার করবেন…সবকিছুতে খাঁটি জিনিসের সন্ধান করুন। এমন জিনিসের অনুসন্ধান করুন যা খাঁটি, যা পবিত্র। সর্বোত্তম জিনিসের খোঁজ করুন। আর জানেন তো? মৌমাছি সবেয়ে ভালো ফুল না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকে, বসে না। তাই, আমাদেরও সেরাটা অর্জন করতে হবে। একজন মু’মিনের দৃষ্টিভঙ্গি এমনই। (ফালইউতকিনহু) তার উচিত দক্ষতা অর্জন করা। আপনাদের সবাই যখন কিছু করবেন তাতে দক্ষতা অর্জন করুন। আপনার উচিত সেরা হওয়া। এটাই মৌমাছি করে, সে সেরা ফুলের সন্ধানে থাকে। এটাই প্রথম শিক্ষা।
——————
তারপর তিনি বলেন – وَوَضَعَتْ طَيِّبًا – (ওয়া ওয়াদা’য়াত তইয়িবান) এটি উত্তম উপায়ে বসে, যেভাবে এটি ফুলের উপর বসে তা খুব সুন্দর। ব্যাপারটা ভালো এবং খাঁটি। আর আপনাকে এ সম্পর্কে গবেষণা করতে হবে। মৌমাছি নিয়ে গবেষণা না করলে তো এটা জানতে পারবেন না। মৌমাছি নিয়ে অধ্যয়ন করলে জানতে পারবেন, তারা শুধু সে ফুলের কাছেই পরাগ নিয়ে যায় যে ফুলের পরাগ দরকার হয়। মৌমাছি যখন কোন ফুল থেকে মধু নিতে যায়, তারা ঐ ফুল থেকে মধু নিবে না যদি না তারা ঐ ফুলকে আরও বেশি কিছু দিবে। তারা একে জীবন দিবে, পরাগ দিবে।
আমাদের সবার জীবনেই বিভিন্ন রকম সম্পর্ক রয়েছে ঠিক যেমন মৌমাছির ফুলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের সম্পর্ক রয়েছে। আপনার আমার প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনি কিছু নেন এবং কিছু দিয়ে থাকেন। আপনার বিবাহের ক্ষেত্রে আপনি কিছু দিয়ে থাকেন এবং কিছু নিয়ে থাকেন। যখন আপনি পিতা বা মাতা হন তখনো কিছু দিয়ে থাকেন এবং কিছু নিয়ে থাকেন। যখন আপনি একজন শিক্ষক তখনো কিছু দিয়ে থাকেন এবং কিছু নিয়ে থাকেন। যখন আপনি কারো চাকরি করেন বা মালিক পক্ষের হয়ে থাকেন তখনো কিছু নিয়ে থাকেন এবং কিছু দিয়ে থাকেন। সবসময় সম্পর্কটা দেওয়া নেওয়ার।
কিন্তু মৌমাছি যা কিছু নেয় তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে থাকে। এটি নেওয়ার চেয়ে দেয় অনেক বেশি। আর যা প্রদান করে তা গ্রহীতার জীবনকে উন্নত করে। আর যা নিয়ে যায় তা গ্রহীতার কোন ক্ষতি করে না। এটি ফুল থেকে যা নেয় তা ফুলের কোন ক্ষতি করে না। وَوَضَعَتْ طَيِّبًا – এটি (ফুলের উপর পাগুলো) রাখে খুব সুন্দর করে। প্রসঙ্গত, ফুলের খুব কোমল জায়গায় মৌমাছিকে বসতে হয়। ফুলের তুলনায় মৌমাছি ভারী একটি জীব। যদি সে তার সম্পূর্ণ ওজন ফুলের ঐ কোমল জায়গায় রাখে তাহলে এটি ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই, এটি ভাসতে থাকে, পুরো ওজন ফুলের উপর রাখে না। এটি পাখাগুলো ঝাপটাতে থাকে যেন সম্পূর্ণ ওজন ফুলের উপর না রাখতে হয়।
আমরা এখান থেকে কী শিখছি? আপনার একটি সম্পর্ক আছে কিন্তু আপনি শুধু দাবি করতে থাকেন, দাবি করতে থাকেন, চাইতে থাকেন, চাইতে থাকেন…তারপর একসময় আপনার প্রিয় বন্ধু, আপনার কর্মচারী, আপনার স্বামী বা স্ত্রী তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। আপনার কিছু জিনিস দরকার, হ্যাঁ আমি একমত। কিন্তু অতিরিক্ত নিতে যাবেন না। সহজে অগ্রসর হউন। তাদেরকে এমন চাপে ফেলবেন না যে তারা ভেঙ্গে পড়বে। আর যদি কিছু চান তাহলে বেশি করে প্রদান করুন। তার জন্য কিছু নিয়ে আসুন তারপর দাবি করুন। আর যখন চাইবেন কম করে চান। জাস্ট, যতটুকু দরকার। যতটুকু প্রয়োজন।
তাহলে وَوَضَعَتْ طَيِّبً – আচ্ছা এটা সুন্দরভাবে বসে, ভালো একটি জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে। এটা সুন্দরভাবে আহার করে।
এর আরেকটি উপকার হল, যদি অন্য কোন মৌচাকের মৌমাছি পাশ দিয়ে অতিক্রম করে এবং দেখে যে একটি মৌমাছি এই ফুল থেকে আহার করছে, তখন সে এসে এখানে কোন ঝামেলা বাঁধায় না। কারণ, যদি দুইটি আলাদা মৌচাকের মৌমাছি একটি ফুলের উপর গিয়ে বসে তখন ফুলের ক্ষতি হয়ে যায়, এর পরাগায়ন আর হয় না। ফুলটি এর ফলে মারা যায়।
তাই, মৌমাছি ব্যাপারটা বুঝতে পারে, সে জানে যে এই ফুলের সাথে ঐ মৌচাকের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, আমার এর কাছে যাওয়া উচিত নয়। এটা নিকটে আসে, গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে, এরপর সে অন্য আরেকটি ফুলের নিকট যায় যাকে স্পর্শ করা হয়নি এখনো।
আর আমরা কী করি? কেউ একটা দোকান খুলল। আরেকজন দেখে ভাবল, “হুম, ভালো ব্যবসা! আমারও ঠিক একই রকম একটা দোকান দিতে হবে রাস্তার ঐ পাশে।” আর এই লোকের সব কাস্টমার নিয়ে যায়। যখনই কোন কাস্টমার ঐ ব্যক্তির দোকানে যেতে নেয়, “ভাই, এদিকে আসেন, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই…।” আমরা কী করি!! আরও শত শত জায়গা আছে যেখানে আমি দোকান দিতে পারি। আল্লাহর রিজিক প্রশস্ত। আমাকে তার প্লেটের ভাত নিজের প্লেটে তুলতে হবে না। এটাই আমরা করি। মানুষ এমন কৃপণের কৃপণ…আমি এমন মুসলিম চাকরিজীবীর কথা জানি যারা অনেক টাকা কামায়, আমি এমন ডাক্তারদের কথা জানি যারা যথেষ্ট টাকা আয় করে, তারপর হয়তো কোন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র যে হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ খুঁজছে, আর এই ডাক্তার তার জন্য সুপারিশ করে না। কারণ, হয়তো পাঁচ বছর পরে সে আমার চেয়ে বেশি আয় করবে। বা দশ বছর পরে। আমি এটা চাই না।
এভাবে আমরা একে অন্যকে সাহায্য করতে চাই না। অথচ, একজন বিশ্বাসীর মনোভাব হওয়া উচিত ছিল এরকম – আচ্ছা, সে তার রিজিক এখানে আয় করছে, আমার উচিত অন্য কোন জায়গায় যাওয়া। আমার তার রিজিকে ভাগ বসানোর দরকার নেই। পুঁজিবাদী সমাজের মত গলাকাটার দরকার নেই। আপনি এই দুনিয়াতে অন্য মানুষের রিজিক দখল করে নিজের টাকা আয় করতে আসেননি। আমি শুধু আমার লাভ বুঝি। আমি এছাড়া অন্য কিছু বুঝি না। সুবহানাল্লাহ!
আর তিনি (স) বলেন – وَوَقَعَتْ فَلَمْ تَكْسِر – এটা বসে কিন্তু ভেঙ্গে ফেলে না। এটা দাবি করে এবং নিজেরটা নেয় কিন্তু ভাঙ্গে না। এটা নেয় সর্বোত্তম পন্থায়। আহার করার কি এক মহৎ পন্থা! বাঁচার কি এক মহৎ পন্থা!
আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু টাকার সাথে জড়িত নয়, সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে, যা আমি একটু আগে বলতে চেয়েছিলাম। আমাদের সকল সম্পর্কের জন্য এখান থেকে যা শিখছি… যদি আমরা একজন বিশ্বাসীর মত আচরণ করতে চাই, যদি আমরা সত্যই মৌমাছির কাছ থেকে কী শিক্ষা নিব তা বুঝতে পারি, যে শিক্ষাটা উপলব্ধি করার প্রতি রাসূল (স) এতো বেশি জোর প্রদান করেছেন, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে – আমি কি আমার বাচ্চাদের উপর অনেক বেশি প্রেশার দিচ্ছি? আমি কি আমার পিতা-মাতার কাছ থেকে অনেক কিছু দাবি করছি? আমি কি আমার স্বামীর কাছে বেশি কিছু দাবি করছি? আমি কি আমার স্ত্রীর কাছে অনেক কিছু আশা করছি? আমি কি আমার বন্ধুর কাছে অনেক কিছু চাচ্ছি? আমি কি আমার কর্মচারীদের উপর অনেক বেশি কঠোর? আমি কি আমার শিক্ষককে অনেক বেশি জ্বালাতন করছি? আপনাকে এই প্রশ্নগুলো করতে হবে। কারণ, আপনি মৌমাছির মত হতে চান।
তারপর সবার শেষে তিনি বলেন – ولم تُفْسِدْ – ” এবং এটি কোন দূষণ তৈরি করে না।”
মৌমাছিদের একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, যে ফুলের কাছে তারা মধু আহরণ করতে যায় তা নিজেদের বাসা থেকে অনেকে দূরে। মৌচাক এক জায়গায় থাকে আর তারা মধু আহরণ করতে বেশ দূরের কোন ফুল বাগানে যায়। সুতরাং, তারা অনেক দূর পথ ভ্রমণ করে, কখনো কখনো তা কয়েক মাইলও হয়ে থাকে। এরপর তারা নিজেদের মৌচাকে ফিরে আসে। আর মৌচাক শুধু তাঁর নিজের বাসা নয়, তার বিশাল প্রতিবেশী রয়েছে, সবাই এই মৌচাকে বাস করে।
আল্লাহ তাদেরকে বিশেষ ধরণের নাচ শিখিয়েছেন। একটি নির্দিষ্ট নিয়মে তারা বাতাসে ভাসতে থাকে, যা অন্য মৌমাছিদের অন্য ফুলের পথ বাতলে দেয়। “দেখ, আমি আমার নিজের জন্য কিছু রিজিক পেয়েছি, তোমরাও অমুক অমুক ফুল থেকে উপকার পেতে পারো। আমি তোমাদেরকে সেই রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।” এটা তখন তাদেরকে পথ দেখিয়ে দেয়। এর নাম হল ”মৌমাছির নাচ।” এর জনপ্রিয় পরিভাষা হল, “মৌমাছির নাচ”। তারা অন্য মৌমাছির সামনে এই নাচ দেখাতে থাকে যেন অন্যরাও বাকি ফুলগুলো থেকে মধু আহরণ করতে পারে। যেনও তারাও খেতে পারে। এভাবে তারা নিজেদের সমাজ তৈরি করে। এভাবে একসাথে তারা নিজেদের মৌচাক নির্মাণ করে। তো, এটা বুঝতে পারে যে, যখন কেউ কোন কিছু থেকে উপকার পেয়ে থাকে – এটা কোন প্রতিযোগিতা নয় – যদি সে অন্যদেরও উপকার পাওয়ার সুযোগ করে দেয়, এর মাধ্যমে আসলে সবাই উপকৃত হয়। আমরা সবাই এর কল্যাণ লাভ করি। আমি নিজে নিজে একটি মৌচাক নির্মাণ করতে পারব না, আমাদের সবাইকে এর জন্য কাজ করতে হবে।
পক্ষান্তরে, মুসলিম সমাজে কী হয় যখন আমাদের ঈমান থাকে না? কেউ যখন উন্নতি করে আমরা হিংসুক হয়ে পড়ি। আর আপনি যদি উন্নতি করেন তাহলে কাউকে বলতে চান না কীভাবে এই উন্নতি করলেন।
– “আচ্ছা, আপনার দোকানের সাপ্লাই কোথা থেকে পান?”
– “আমি জানি না। ভুলে গেছি।”
– “আচ্ছা, চাকরির জন্য কোথায় আবেদন করেছেন? আপনার রেজিউমি কেমন?”
– “আমি জানি না। ফাইলটা হারিয়ে ফেলেছি।”
আপনি কাউকে সাহায্য করতে চান না। এটা হল প্রতিযোগিতা। আমি কেন প্রতিযোগিতায় আরেকজনকে সাহায্য করব? আমি কেন তাকে বোর্ড কমিটিতে সিট পেতে সাহায্য করব? না, না, এটা করা যাবে না। আপন চরকায় তেল দাও।
আর রাসূলুল্লাহ (স) মৌমাছির মাঝে সীমাহীন বিজ্ঞতা দেখতে পেলেন। কারণ, আল্লাহ তাঁকে বলেছেন দেখো, আমি মৌমাছির নিকট ওহী প্রেরণ করি। “ওয়া আওহা রাব্বুকা ইলান নাহাল।”
যে পথটা মৌমাছি অনুসরণ করে আল্লাহ তাকে বলেছেন, সুবুলা রাব্বিক। মৌমাছি বৃত্ত তৈরি করে দুলতে দুলতে সামনে চলতে থাকে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তাদের এই ভ্রমণ পথ দেখা সম্ভব নয়। আর আল্লাহ বলছেন প্রতিটি বাঁক যে এটি নিয়ে থাকে, সেটা তার রবের দেখানো পথ। আল্লাহ তাদের জন্য এই পথটি তৈরি করেছেন। আর তিনি এটাকে ‘জুলুলান’ (ذُلُلًا) বলেছেন। এই আয়াতে যে ‘হাল’ ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ذُلُلًا আর ذُلُلًا দ্বারা ইঙ্গিত করা হয় এটি নম্রতার সাথে এগিয়ে চলে। আল্লাহ বর্ণনা করছেন – মৌমাছি নম্রতার সাথে এগিয়ে চলে। এর একটা চাকরি আছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, এটা একটা মিশনে আছে, একটা লক্ষ্য পানে এগিয়ে চলছে, কিন্তু তাই বলে এটা অহংকারী নয়।
অনেক সময় দেখবেন, মানুষ ব্যস্ত সময় কাটালে কেমন জানি অহংকারী হয়ে উঠে। “আমি মারাত্মক ব্যস্ত। তোমার জন্য আমার সময় নেই। পরে কল দিও।” আর আপনাদের মাঝে কেউ কেউ বড় চাকরি করেন, মাকে কল দেওয়ার সময় নেই। অন্যদিকে মৌমাছি ‘জুলুলান’ তথা কাজ করতে যাওয়ার সময়েও নম্রভাবে পথ চলতে থাকে। সুবহানাল্লাহ!
সবশেষে যা বলতে চাই – আর দুই মিনিট সময় আছে – আমি মৌমাছি নিয়ে শেষ একটি কথা বলতে চাই। যদিও আরও অনেক কিছু বলার ছিল। শেষ একটা কথা। আল্লাহ এই জীবটাকে অসাধারণ করে বানিয়েছেন, আর এটাকে তার নিজের কাজ করার যোগ্য করে তৈরি করেছেন, এটা নিজের জীবিকা আহরণ করছে। পাঠগুলো নিয়ে এভাবে চিন্তা করতে পারেন – এই মৌমাছির অন্যদের সাথে সম্পর্ক আছে, নিজে উপকৃত হচ্ছে, সমাজের সবার উপকার করছে, চারপাশের পরিবেশের উপকার করছে। কিন্তু এই সবকিছুর বাহিরে, এই সবকিছুর উপরে এটা মৌচাক নির্মাণ করে। আর এই মৌচাকে আপনি মধু পেয়ে থাকেন। এই মধুর উপকার মৌমাছিকে ছাড়িয়ে আর বহু সৃষ্টির মাঝে ছড়িয়ে পড়ে… যা “শিফাউন লীন নাস” এই মধুতে মানব জাতির জন্য রয়েছে চিকিৎসা। ছোট্ট এই প্রচেষ্টা থেকে। সুবহানাল্লাহ!
আমরা এখান থেকে কী শিখছি? আমরা যদি মুমিনদের একটি সমাজ তৈরি করতে চাই, আমরা যদি পরস্পরের উপকার করা শিখতে চাই, আমরা যদি একসাথে ভাই-ভাই হয়ে বাস করতে চাই এবং অল্পে তুষ্ট থাকি, আমাদের সম্পর্কগুলোর উপর বেশি চাপ না দিয়ে থাকি – এর ফলে আমরা যে সমাজ নির্মাণ করব এতে শুধু নিজেদের উপকার হবে না, বরং মানবতা এর দ্বারা উপকৃত হবে, আরোগ্য লাভ করবে।
যদি মৌমাছিদের একটি সমাজ পৃথিবীকে আরোগ্য দান করতে পারে… কত শত রোগবালাই মধুর মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করে, রাসূল (স) কর্তৃক সত্যায়িত একটি ঔষধ হল মধু। আর মধু কখনো তৈরি হয় না যতক্ষণ না মৌমাছির একটি সমাজ একত্রে বসবাস করা শিখে এবং একত্রে কাজ করা শিখে। যদি এই উম্মাহ – যার মৌমাছির মত হওয়ার কথা – যদি আমরা একসাথে কাজ করা শিখি, একত্রে বসবাস করা শিখি এবং আমাদের নিজস্ব সমাজ তৈরি করি, এর ফলে আমরা শুধু নিজেদের উপকার করব না, আমরা মানব জাতির জন্য আরোগ্য লাভের এক উপায়ে পরিণত হব। কারণ, মানব জাতি আজ লোভী হয়ে পড়েছে, সবাই শুধু নিজের চিন্তায় ব্যস্ত, তারা বলে “আগে নিজের চরকায় তেল দাও। আমরা এই গ্রহকে জ্যান্ত সাবাড় করে ফেলছি।
প্রসঙ্গত, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, আজ যেহেতু পৃথিবীতে ফিতনা বেড়ে গেছে, পৃথিবীতে আরেকটি ট্রাজেডিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মৌচাকগুলো দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার অন্যতম একটি নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে।
————–
তাইতো, সবশেষে রাসূলুল্লাহ (স) বলেন – ولم تُفْسِدْ (এটা ফ্যাসাদ তৈরি করে না।) – এটা আহার করার মাধ্যমে আরও বেশি জীবন তৈরি করে। যখন মৌমাছি আহার করে এটি আরও জীবন তৈরিতে সাহায্য করে। আজকের দুনিয়ায় যেভাবে ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রিগুলো কাজ পরিচালনা করে, যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো হয়, যেভাবে আপনি-আমি ভোগ করি, আমরা জীবন বৃদ্ধি করি না; বরং আমরা উৎপাদন করি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মৃত্যু ঘটানোর মাধ্যমে। আমরা পৃথিবীতে অনেক বেশি দূষণ তৈরি করি, আমরা পৃথিবীতে অনেক বেশি বিষাক্ত গ্যাস/ক্যামিক্যাল নির্গত করি, আমরা অনেক বেশি সামাজিক অপচয় এবং অর্থনৈতিক অপচয় তৈরি করি, শুধু বস্তুগত অপচয় নয়। আমরা দুনিয়াতে ফ্যাসাদ তৈরি করি। আর রাসূল (স) বলেছেন – মৌমাছির মত ভোগ করতে শেখ যেন পৃথিবীতে ফ্যাসাদ তৈরি থেকে বিরত থাকতে পারো। পৃথিবীকে আরও বাস যোগ্য করে তোল। তোমরা তোমাদেরটা নিতে পারো কিন্তু এর মানে এটা নয় যে পৃথিবীকে এর জন্য বিশাল মূল্য দিতে হবে।
——–
এর মানে এটা নয় যে পরবর্তী প্রজন্মকে এর জন্য মূল্য দিতে হবে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ আমাদেরকে এর কদর করতে সাহায্য করুন। আমাদের চিন্তাশীল মানুষে পরিণত করুন। আল্লাহ আমাদেরকে গভীর জ্ঞানপূর্ণ এক ধর্ম দান করেছেন। আল্লাহর শপথ! যদি এই ধর্ম নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে এটা অন্যরকম এক বিষয়। আর যদি সারাজীবন ধরে শুধু অনুসরণ করে আসছেন কিন্তু কোনোদিন এই ধর্ম নিয়ে চিন্তা করেননি, তাহলে এটা সম্পূর্ণ ভিন্নরকম একটি বিষয়।
আল্লাহ আমাদের চিন্তাশীল মানুষে পরিণত করুন, ভাবুক মানুষে পরিণত করুন এবং এমন মানুষে পরিণত করুন যারা আসলেই কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করতে পারে এবং রাসূলের হাদিসের গভীর শিক্ষা নিয়ে ভাবতে পারে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
কোন মন্তব্য নেই