যোগ্যতা ও আত্ম-বিশ্বাস || ১ম পর্ব

 যোগ্যতা ও আত্ম-বিশ্বাস || ১ম পর্ব

ইউসুফ (আ) যখন স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন, মিশরকে অনাগত ধ্বংস থেকে রক্ষা করলেন, এটা শুনে রাজা তাঁকে ডাকতে বললেন।
وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِى بِهِۦٓ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِى ۖ
﴾রাজা বলল: ‘ইউসুফকে আমার নিকট নিয়ে এসো; আমি তাকে আমার একান্ত‎ সহকারী নিযুক্ত করব।﴿ [সূরা ইউসুফ: ৫৪]
একান্ত লোক করা মানে তিনি অনেক উপরের লোক। তাঁর অধস্তনে যতো লোক আছে, তাদের কাউকে তিনি জবাবদিহি করবেন না। রাজার খুব কাছের মানুষ, অনেক সম্মানিত একটা অবস্থান পেলেন তিনি। এটা উনার যোগ্যতার কারণেই পেলেন।
তিনি ছিলেন জেলখানার বন্ধী। কিন্তু উনার সততা ও যোগ্যতা ছিল। যখন এই সততা ও যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ এলো, সেটা নিয়ে তিনি কল্যাণের পথে হাটলেন, সমস্যার সমাধান দিলেন। সততা ও যোগ্যতার কারণে, জেলাখানার বন্ধিত্ব থেকে এক সুযোগে একদম উপরের মর্যাদাশীল পদে আসীন হলেন।
রাজা তাঁর সততা ও যোগ্যতা আঁচ করতে পেরে তাঁকে এমন পদ দিলেন, যেখানে তাঁর সামনে আসার মতো, বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকবে না।
আমরা জানি একটি প্রতিষ্ঠানে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি থাকে। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে উপরের মহাপরিচালক/CEO/MD, এমন ধরনের শ্রেণীবিভাগ থাকে। নীচের জন উপরের নেতৃত্বের কাছে, এভাবে সবাই সবার কাছে দায়বদ্ধ থাকে, জবাবদিহি করতে হয়। এমন থাকলে কিছু সমস্যাও থাকে। নীচে কেউ ভালো ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক থাকলে তাঁর ভালো পরামর্শও উপরে যেতে পারে না রাজনীতি ও ঈর্ষার কারণে।
কিন্তু, ইউসুফ (আ) এর যোগ্যতা এতোটাই বেশি যে, নীচের, মাঝের কোনো পদ তাঁকে দিলেন না। কারণ, এমন অনেক বিষয় থাকতে পারে যেটা রাজার কাছে আর আসবেই না। ইতোপূর্বেও স্বপ্নের ব্যাখ্যা নেওয়ার পর তাঁকে রাজার কাছে নেওয়া হয় নাই। ফলে উনাকে আরো বেশিদিন জেলে থাকতে হয়েছিল। রাজ্য আরো কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। এজন্য রাজা সেই বাঁধা রাখলেন না। কারণ, উনার মাঝে পদক্রম থাকলে উনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর উপরের পদের লোকেরা তাঁর পরামর্শ আর রাজার কাছেই যেতে দিবে না। ফলে, নীচের পদ দেওয়ার কারণে রাজা অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবেন। এজন্য রাজা তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী, তাঁর সততার জন্য সর্বোচ্চ পদে আসীন করলেন; যেন তাঁর থেকে সর্বোচ্চ কল্যাণ পাওয়া যায়। তাঁকে রাজার ডান হাত বানানোর সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইউসুফ (আ) তখনও রাজার কাছে আসেন নি। তাঁকে আনা হলো রাজার সামনে। মাঝে হয়তো কিছু কথাও হয়েছে, কুর’আনে সেই আলাপের অতো বিস্তারিত আসেনি। তো, কুর’আন বলছে,
فَلَمَّا كَلَّمَهُۥ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ
﴾অতঃপর রাজা যখন তার সাথে কথা বললেন: তখন রাজা বললেন: ‘নিশ্চয়ই‎ আজ তুমি আমাদের নিকট মর্যাদাশীল, বিশ্বাসভাজন।﴿ [সূরা ইউসুফ: ৫৪]
এখানে مَكِينٌ শব্দটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটা আল্লাহ হযরত জিব্রাইল (আ) এর জন্য ব্যবহার করেছেন। যেহেতু উনার মর্যাদাও অনেক বেশি, যিনি আল্লাহর বার্তা সরাসরি বহন করে থাকেন। তাই, সেখান থেকেই বোঝা যায়, রাজা ইউসুফ (আ) কে কতোটা মর্যাদাশীল পদ দিলেন। যেন আজকের যুগের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি পদ। এটা তখনকার সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী পদ।
শব্দটা আবার অবস্থান অর্থে আসে। এর মানে, উনাকে এই পদে স্থায়ীভাবে পদায়ন করা হলো। অনেক লোক আসবে-যাবে, কিন্তু উনি কখনো এই পদ থেকে সরবে না, বাতিল হবে না।
মাকান শব্দটা ইমকান থেকে আসলে আরো বিস্তৃত অর্থ আসে। এর মানে, পাখি যেমন তাঁর ভেতরে অনেক ডিম নিয়ে থাকে, ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে থাকে; তেমনি রাজা তাঁকে এই রাজ্যের অনেক বিষয় ও সম্পদের উপর ক্ষমতা দিলেন। অর্থাৎ, ইউসুফ (আ) কে কেবল বড় পদই দিলেন না, বরং কাজ করার জন্য অনেক ক্ষমতা ও বিস্তৃত সম্ভাবনার দ্বারও উজার করে দিলেন।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধরা পড়ে الْيَوْمَ শব্দ থেকে। কেননা, এর মানে “আজই”। রাজা উনার যোগ্যতা ও সততার ব্যাপার তো জানতেনই। উনি আসার আগেই সভাসদের কাছে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন যে তাঁকে একান্ত ব্যক্তিগত লোক হিসেবে রাখবেন। এরপর কথা বলার পর, সাথে সাথেই যেন বলে দিলেন,
‘আজ, এখন থেকেই তুমি এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হলে, দেরি করা চলবে না।’
এখনো কোনো পজিশন বা কোন কাজের জন্য ইউসুফ (আ) কে নিয়োগ দেওয়া হলো, সেটা নির্ধারিত হয়নি। তবুও তাঁকে বিশাল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু উনার সততা ও যোগ্যতার জন্য উনাকে আরেকটি বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন রাজা। أَمِينٌ শব্দটি দিয়ে সেটাই বলা হয়েছে। ‘আমিন’ মানে কেবল বিশ্বস্ত এমন নয়, বরং তোমাকে সমস্ত কাজ ও ক্ষমতায় আমি আমার বিশ্বাস্ততা সঁপে দিলাম।
لَدَيْنَا মানে আমাদের নিকটে, একদম কাছে। ‘মাকিন’ বা স্থায়ী পদে অনেকেই থাকতে পারে। কিন্তু রাজার কাছের, একান্ত লোক একটাও নেই সভাসদে, রাজ্যে। ইউসুফ (আ) এর যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার কারণে তাঁকে এমন এক উচ্চ পদে মর্যাদায় আসীন করলেন যেটা ইতোপূর্বে ছিলোই না। মানে, তাঁর জন্য নতুন একটা পদই তৈরি করলেন রাজা নিজে!
এখন, রাজার ওখানে অনেক লোক রয়েছে যারা স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরেই আছে। কিন্তু, রাজা জানতেন সবাই এরকম বিশ্বস্ত নয়। ফলে, এমন একজনকে আজ পাওয়া গেলো যার কাজের যোগ্যতা-দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা উভয়ই রয়েছে। ফলে তাঁকে এমন এক পদ-পজিশন দিলেন, যা ইতিপূর্বে আর কাউকেই দেওয়া হয়নি। এটা একইসাথে যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা থাকার মূল্য।
মানুষের যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা তাঁকে এমন অবস্থানে নিয়ে যায়, যা কল্পনাও করা যায় না। এদুটি গুণের কারণে তো ইউসুফ (আ) স্থায়ী ও সবচেয়ে বড় পদ পেলেন স্থায়ীভাবে, বিশাল ক্ষমতা ও বিস্তৃত সম্পদের উপর; তাও রাজার একদম কাছের লোক হিসেবে।
যতক্ষণ না নিজেকে কাজে নিয়োজিত করবেন, ততক্ষন আপনি জানতে পারবেন না, আপনার আসলে কী যোগ্যতা রয়েছে? আপনি আপনার শক্তি এবং দুর্বলতা কোনোটাই ধরতে পারবেন না। কোনো কাজ করার আগে ভয় পাওয়া বন্ধ করুন। উদ্যোগ নিতে ভয় পাবেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ভয় পাবেন না। ব্যর্থতা আসলে আপনার জন্যে ভাল। এটা কোথায় ফাটল আছে তা দেখিয়ে দেয়। আপনাকে কোথায় উন্নতি করতে হবে তা দেখিয়ে দেয়। আবার আপনি কিসে ভাল সেইটাও দেখিয়ে দেয়, হয়ত আপনাকে এতে আরও ভাল হতে হবে, কিন্তু এসব কখনই হবে না যদি আপনি চেষ্টাই না করেন। যতক্ষণ না আপনি নিজেকে কাজের মাঝে নিযুক্ত করবেন।
বইঃ প্রশান্তির খোজে : ২

উস্তাদ নোমান আলী খান

[অধ্যায়ঃ জীবন, দক্ষতা, উন্নয়ন]

কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.