আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম এর তাফসির।।

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম এর তাফসির

আসুন জেনে নিই ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম’ এর অর্থ, ফজিলত এবং তা কখন ও কোন কারণে পাঠ করতে হয়।
=

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

এর অর্থ হলো:-
- বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।
আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম-এই বাক্যের সঙ্গে পরিচয় নেই, মুসলিম সমাজে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ‘আউজু বিল্লাহ’ আরবি শব্দ। পূর্ণ বাক্য ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম
 আউজুবিল্লাহকে এক কথায় ‘তায়াউজ’ বলা হয়।  
আউজু বিল্লাহ পড়ায় রয়েছে অনেক ফজিলত। কিন্তু আউজু বিল্লাহ পাঠের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেকেই জানে না। যা জানা থাকা অত্যন্ত জরুরি। 

নিম্নে আউজু বিল্লাহ পাঠের উপকারিতা ও ফজিলত তুলে ধরা হলো-
আল্লামা ইবনে কাসির রহিমা হুল্লাহ বলেন, বেশি পরিমাণ আউজুবিল্লাহ পাঠে মানুষের জিহ্বা মন্দ ও নিন্দনীয় কথার প্রতিক্রিয়া থেকে পবিত্রতা লাভ করে। শয়তান দূরে সরে যেতে বাধ্য হয় এবং মানুষ আল্লাহ তায়ালার আশ্রয় লাভ করে। অন্যায়-অশ্রাব্য - অশ্লীল বাক্য উচ্চারণের ফলে মুখে যে অপবিত্রতা লেগে যায়, আউজু বিল্লাহ বলার কারণে তা ধুয়ে যায়।মুখ হচ্ছে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের অঙ্গ। আউজু বিল্লাহ পাঠের মাধ্যমে মুখ কুরআন তিলাওয়াতের যোগ্যতা অর্জন করে। শয়তানের মারাত্মক আক্রমণের মোকাবিলার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়।শয়তান মানুষকে দেখে, কিন্তু মানুষ শয়তানকে দেখে না। আবার আল্লাহ শয়তানকে দেখেন কিন্তু শয়তান তাকে দেখে না, বিধায় সেই মহান শক্তির আশ্রয় ছাড়া শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচার কোনো বিকল্প পথ নেই।আউজুবিল্লাহ পাঠেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন উপকার। 

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বনির রজীম’ পাঠ করার ৫টি স্থান তুলে ধরা হলো-
‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ পাঠ করার কতিপয় ক্ষেত্র-
(১) কোরআন তেলাওয়াতের শুরুতে: কোরআন তেলাওয়াত একটি ইবাদত। কোরআনের প্রতিটি হরফ পাঠের বিনিময়ে ১টি করে নেকি রয়েছে। আর একটি নেকি অন্যন্য ১০টি নেকির সমান। (তিরমিযী; মুসতাদরাকে হাকেম; মিশকাত হাদিছ সহিহ)। 
তাই কোরআন তেলাওয়াতের সময় যাতে শয়তান ধোঁকা দিতে না পারে সেজন্য কোরআন তেলাওয়াতের পূর্বে আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়ার নিদের্শ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآَنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
‘যখন তুমি কোরআন তেলাওয়াত করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে’(সূরা: ১৬.নাহল, আয়াত: ৯৮)।
(এর অর্থ কেবল এতটুকুই নয় যে, মুখে শুধুমাত্র أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيطَنِ الرَّجِيم উচ্চারণ করলেই হয়ে যাবে। বরং এ সঙ্গে কুরআন পড়ার সময় যথার্থই শয়তানের বিভ্রান্তিকর প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকার বাসনা পোষণ করতে হবে এবং কার্যত তার প্ররোচনা থেকে নিষ্কৃতি লাভের প্রচেষ্টা চালাতে হবে।)
(২) সালাতে শয়তান ওয়াসওসা (কুমন্ত্রণা) দিলে: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
عن عُثْمَانَ بْن أَبِي الْعَاصِ رضي الله عنه أنه أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ حَالَ بَيْنِي وَبَيْنَ صَلَاتِي وَقِرَاءَتِي يَلْبِسُهَا عَلَيَّ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( ذَاكَ شَيْطَانٌ يُقَالُ لَهُ خَنْزَبٌ ، فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْهُ وَاتْفِلْ عَلَى يَسَارِكَ ثَلَاثًا قَالَ : فَفَعَلْتُ ذَلِكَ فَأَذْهَبَهُ اللَّهُ عَنِّي .
ওসমান বিন আবুল ‘আস (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! শয়তান আমার মধ্যে এবং আমার সালাত ও কেরাআতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে আমার কেরাআতে জটিলতা সৃষ্টি করে। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ হচ্ছে শয়তান, যাকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। তুমি তার আগমন অনুভব করলে আল্লাহর নিকট তিনবার আশ্রয় প্রার্থনা করবে (অর্থাৎ আউযুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম পাঠ করবে) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু ফেলবে।’
তিনি (ওসমান রা.) বলেন, ‘এরপর থেকে আমি এমনটি করি। ফলে আল্লাহ তাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন।’ (সহিহ মুসলিম হা/২২০৩)।
(৩) রাগের সময়: রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। তাই রাগের সময় শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে। সুলায়মান ইবনু সূরাদ (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন দু’জন লোক গালা গালি করছিল। তাদের একজনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগ গুলো ফুলে গিয়েছিল। 
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
 
إِنِّي لأعلَمُ كَلِمةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عنْهُ مَا يجِدُ، لوْ قَالَ: أَعْوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ذَهَبَ منْهُ مَا يجدُ 
‘আমি এমন একটি দোয়া জানি, এই লোকটি তা পড়লে তার রাগ দূর হয়ে যাবে। সে যদি পড়ে ‘আউযুবিল্লা-হি মিনাশ শায়তানির রাজীম’ তবে তার রাগ চলে যাবে।’
তখন সুলায়মান তাকে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে আশ্রয় চাও। সে বলল, আমি কি পাগল হয়েছি?।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেনঃ নবী ﷺ এর সামনে একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সি‌দ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলো। হযরত আবু বকর চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী ﷺ মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটি কঠোর কথা বলে ফেললেন। তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবীর ﷺ ওপর চরম বিরক্তি ভাব ছেয়ে গেল এবং ক্রমে তা তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুট উঠতে থাকলো। তিনি তখনই উঠে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরও উঠে তাঁকে অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিলো তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? নবী ﷺ বললেনঃ তুমি যতক্ষন চুপচাপ ছিলে ততক্ষন একজন ফেরেশতা তোমার সাথে ছিল এবং তোমার পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু যখন তুমি নিজেই জবাব দিলে তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল। আমি তো শয়তানের সাথে বসতে পারি না।
(৪) খারাপ স্বপ্ন দেখলে: জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا رَأَى أَحَدُكُمُ الرُّؤْيَا يَكْرَهُهَا، فَلْيَبْصُقْ عَنْ يَسَارِهِ ثَلَاثًا وَلْيَسْتَعِذْ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ ثَلَاثًا وَلْيَتَحَوَّلْ عَنْ جَنْبِهِ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ
‘যদি তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে না, তাহলে তিনবার বাম দিকে থুথু দেবে। আর তিন বার শয়তান থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাবে (অর্থাৎ আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম পাঠ করবে।) আর যে পার্শ্বে শুয়েছিল, তা পরিবর্তন করবে। (অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শুবে)।’ (সহিহ মুসলিম)।
(৫) মনের মধ্যে শয়তান কুমন্ত্রনা দিলে: আল্লাহ বলেন,
إِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّـهِ
‘শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (সূরা: আ‘রাফ, আয়াত: ২০০; ফুসসিলাত: ৩৬)।
اِنَّ الَّذِیْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طٰٓئِفٌ مِّنَ الشَّیْطٰنِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَاهُمْ مُّبْصِرُوْنَۚ
প্রকৃতপক্ষে যারা মুত্তাকী, তাদেরকে যদি কখনো শয়তানের প্রভাবে অসৎচিন্তা স্পর্শও করে যায়, তাহলে তারা তখনই সতর্ক হয়ে ওঠে, তারপর তারা নিজেদের সঠিক কর্মপদ্ধতি পরিষ্কার দেখতে পায়।
(আল-আরাফ,:আয়াত: ২০১,)।
وَ قُلْ رَّبِّ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّیٰطِیْنِۙ
আর দোয়া করো, “হে আমার রব! আমি শয়তানদের উস্কানি থেকে তোমার আশ্রয় চাই।(২৩: আল-মু’মিনূন,:আয়াত: ৯৭,)
# পরিসরে বলতে চাই:-
আল্লাহ তা'আলা এই আয়াতসমূহে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, মানুষের শত্রুতার সবচাইতে ভালো ঔষুধ হলো প্রতিদানে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। এরুপ করলে তখন শত্রুতা করা থেকেই বিরত থাকবে না, বরং অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হবে। আর শয়তানের শত্রুতা হতে নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে বলেছেন । কেননা শয়তানরূপে অকৃত্রিম শত্রুদেরকে উত্তম ব্যবহার দ্বারা আয়ত্তে আনা কখনো সম্ভব নয়। কারণ সে মানুষের বিনাশ ও ধ্বংসের মধ্যে আমোদ পায়।



কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.