সুরা ইখলাসের আলোচনা -১

সুরা ইখলাস


সূরা ইখলাসের প্রথম আয়াত- قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ "বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।" শুধুমাত্র এই উক্তিটির মাধ্যমে আল্লাহ বলছেন, এটা এমন অদ্বিতীয়তা যা তোমরা অন্য কোনো অদ্বিতীয়তার সাথে তুলনা করতে পারবে না। এমনকি তাঁর অনন্যতাও অনন্য। তাঁর তাওহীদও অনন্য।

আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যত চিন্তা আপনার আছে, এটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যত চিন্তা আপনার আছে, আল্লাহ সম্পর্কে অন্য যতো কিছু আপনি শিখবেন, আপনাকে প্রথমে অনুধাবন করতে হবে যে, সেই সকল জিনিস থাকবে এই একটি শব্দের ছায়াতলে। আর তা হলো - أَحَدْ (অদ্বিতীয়)  
সকল উপলব্ধি 'আহাদুন' শব্দটির ছায়াতলে থাকবে। 

কেনো আমি এটা বললাম ? খেয়াল করুন, আমি শুনি। আমি দেখি। আমি سَمِيْع (সামি), অর্থাৎ আমি শুনি। আমি بَصِيْر (বাসির), যার অর্থ কি ? আমি দেখি। আমার কিছু জ্ঞান আছে, আমি عَلِيْم (আলীম) ও। কিন্তু سَمِيْع (সামি), بَصِيْر (বাসির), عَلِيْم (আলীম) এগুলো কি আল্লাহরও নাম ? হ্যাঁ, এগুলো আল্লাহর নাম। 

আল্লাহর একটি নাম হলো رَحِيْم (রহীম), তাই না ? আল্লাহর আরেকটি নাম হলো رَؤُوْف (রউফ)। এই দুটি নাম ব্যবহৃত হয়েছে রাসূল (সঃ) এর জন্যও। আর আল্লাহ তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ (বিল মু’মিনিনা র’উফুর রহীম)। রাসূল (সঃ) এর বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি হলেন ইমানদারদের প্রতি رَؤُوْف (রউফ) এবং رَحِيْم (রহীম)। مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ (মা গররাকা বি রব্বিকাল কারীম)। وَجَاءَهُمْ رَسُولٌ كَرِيمٌ (ওয়া জাআকুম রাসূলুন কারীম)। 

'কারীম' আল্লাহর জন্য, 'কারীম' মূসা (আঃ) এর জন্য। রহীম আল্লাহর জন্য, রহীম নবিজীর জন্য, রউফ আল্লাহর জন্য, রউফ নবিজীর জন্য। কিভাবে আমরা এটা বুঝবো ? কোন শব্দটির ছায়াতলে আল্লাহর অন্য নামগুলো চলে আসে ? أَحَدْ 

যখন তিনি শুনেন, তাঁর শ্রবণ অন্য কারো শ্রবণের মতো না। যখন তিনি দেখেন, তাঁর দৃষ্টি অন্য কোনো দৃষ্টির মতো না। এটা কখনোই তুলণা করা সম্ভব না। এটা অনন্য। 

যখন তিনি রাগান্বিত হন, আপনি তাঁর ক্রোধকে অন্য কারো সাথে তুলণা করতে পারবেন না। এর অর্থ শুধু এটা না যে তিনি সকলের চেয়ে বেশী ক্রোধান্বিত। আমার বাবা রাগান্বিত হন কিছু বিষয়ে, আমি রাগান্বিত হই কিছু বিষয়ে, আমার বাচ্চারা রাগান্বিত হয় কিছু বিষয়ে, আপনার বস রাগান্বিত হন কিছু বিষয়ে। মানুষ কোনো কোনো বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে উঠে। কখনোই মানুষের রাগকে আল্লাহর রাগের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না। 

যখন আমি আমার মা-বাবাকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার সন্তানকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার ভাইকে রাগান্বিত করি, যখন আমি আমার বন্ধুকে রাগান্বিত করি, আর তারা আমার সাথে আর কথা বলতে চায় না, তারপর যখন আমি আল্লাহর রাগান্বিত হওয়ার মতো কাজ করি, আমি মনে করি যে আল্লাহও একইভাবে বিবেচনা করেন। আমি আল্লাহকে রাগান্বিত করেছি, তিনি আমার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যরা যেমন আমার আশা ছেড়ে দিয়েছে, আল্লাহও আমার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি একটি শব্দ সম্পর্কে বেখেয়াল হয়ে যাচ্ছেন - أَحَدْ আপনি হয়তো অন্য সবাইকে রাগান্বিত করেছেন, তারা হয়তো আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে। আপনি আল্লাহকে রাগান্বিত করেন, আল্লাহ কি আপনাকে ছেড়ে যান ? না। না। তিনি অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ অপেক্ষা করেন - আপনার জন্য যেনো তাঁর কাছে ফিরে আসেন। 

আপনি হয়তো আল্লাহ থেকে হাজার মাইল দূরে। আর আপনি আল্লাহর দিকে এক কদম অগ্রসর হলেন। এটাকে অন্য কারো সাথে তুলণা করুন। আপনি আপনার সহোদর বোনের কাছ থেকে এক হাজার কদম দূরে সরে গেলেন। একটা ঝগড়া হলো, এরপর ১০ বছর কথা বলা বন্ধ। আপনারা একে অপরকে ঘৃণা করেন। সে আপনার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। আর এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ছোটো কদম উঠানোর তাঁর উদ্দেশ্যে। আপনি কি আশা করেন যে সে আপনার কাছে দৌড়ে ছুটে আসবে ? না। “এতদিন পর এসেছো ? আর তুমি ‘সরি’ও বলনি ? এটা কি ? হাহ। তুমি কি মনে করেছো আমি সবকিছু ভুলে গেছি ? ভুলে যাবো তুমি কি বলেছো, তুমি যা করেছো ?” মানুষ কি এমনটাই করে না ? এমনকি তারাও যারা আপনাকে ভালোবাসে ? তারা ভুলে যায় না, তারা ছেড়ে দেয় না, তারা এগুলো মনে ধরে রাখে। সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যায় না। এটাই কি ঘটে না ? 

যদিও আপনি মিমাংসা করে ফেলেন, পরের ঝগড়ায়, “আমার কখনোই তোমাকে ক্ষমা করা উচিৎ হয়নি। তুমি আগের মতোই আছো।” এরকমই কি ঘটে না মানবজাতির মধ্যে ? এখন, আমরা আল্লাহর সাথে অন্যায় করে ফেলি। আর আমাদের উপর মানুষের আশাভঙ্গ হওয়াতে আমরা এতোই অভ্যস্ত, মানুষের রাগের সাথে, মানুষের হতাশার সাথে আমরা এতোই অভ্যস্ত যে, আমরা মনে করি আল্লাহর রাগও একইভাবে কাজ করে। “আল্লাহ আমার উপর আশা হারিয়ে ফেলেছেন। কিভাবে এখন আমি তাঁর সাথে কথা বলবো। এখন আর কি করার আছে।” যখন আপনি উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহ হলেন أَحَدْ , (অদ্বিতীয়) তখন তাঁর সাথে আপনার সম্পর্কটি পরিশোধিত হয়ে যাবে অন্য সম্পর্কগুলো নিয়ে তৈরী মনোভাবের তুলণায়। 

ক্ষমাশীলতা, ক্রোধ, করুণা, ভালোবাসা, তত্ত্বাবধান, ন্যায়পরায়নতা সবগুলো নিয়ে ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, কারণ আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করছেন أَحَدْ হিসেবে। 

এটা বলতে আমি ক্লান্তি বোধ করি না যে, এই বাণীটি, আল্লাহর দীনের এই বাণীটি হলো আশার বানী। এটা আসলে আশাবাদী হওয়ার বাণী। যখন মানুষ মনে করে যে আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। সে কঠিন সময় পার করছে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিচ্ছেন। আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, আল্লাহ তাকে ভুলে গিয়েছেন। আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত, সেজন্যই সে এই দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। “কেনো আল্লাহ আমাকে এই অবস্থায় রেখেছেন ? কেনো এমনটা ঘটছে আমার সাথে ? কেনো আমি ? কেনো আমি ? কেনো আমি ?” 

আমি আপনাকে দুইটি বিষয় বলবো। এক, প্রথমত, যখন আপনি বলছেন যে, কেনো আল্লাহ আপনার সাথে এমনটা ঘটতে দিচ্ছেন, হতে পারে যেই সকল যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন, তা হয়তো কম মূল্যবান হতে পারে একটি জিনিসের তুলণায় - আপনার আল্লাহর কাছে ফিরে আসার তুলনায়। শুধু আপনার আল্লাহর কাছে ফিরে আসা। 

আল্লাহ জানেন যে, যদি তাঁর কাছে ফিরে না আসেন আরো অনেক কঠিন যন্ত্রণা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, আর তাই তিনি শুধু আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। শুধু এটুকুই। এটা তাঁর ভালোর জন্য না, এটা আপনার জন্য ভালোর জন্য। এটা আপনার জন্য অন্য সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান। إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ (সে ব্যক্তি সফল যে আল্লাহর কাছে প্রশান্ত অন্তর নিয়ে হাজির হবে) আর আপনি তাঁকে সেই সুযোগ দিচ্ছেন না। কারণ আপনি তাঁর সম্পর্কে সেরকম ধারণাই করছেন যেমন ধারণা অন্যদের ব্যাপারে করেন। 

অন্য সবাই হয়তো আপনার কাছে কিছুর জন্য দায়বদ্ধ হতে পারে। যখন কাউকে ধন্যবাদ দেন...যদিও ধন্যবাদের অর্থ হওয়া উচিৎ এরকম যে, আমি আপনার কাছে ঋণি। কিন্তু আপনি অসন্তুষ্ট হয়ে যান, “আপনাকে স্বাগতম" (you are welcome ) বললেন না যে ! 

কেউ বললো, “ধন্যবাদ।” আর আপনি বললেন, “আমি জানি, আমি এ ধন্যবাদ প্রাপ্য ।” এখানে প্রত্যাশা রয়েছে; তাই না ? ধরুন কাউকে সাহায্য করলেন। কমপক্ষে তার কাছে কি বলার আশা করেন ? ধন্যবাদ। আপনি কিছু প্রত্যাশা করছেন। মূলত, আমাদের জীবনের সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রেই কিছু প্রত্যাশা থাকে। 

আপনার কাছে এবং আমার কাছে আল্লাহর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তিনি আমাদের কাছে কোনো কিছুর জন্য দায়বদ্ধ নন। আপনি এবং আমি এটা বলার অবস্থানে নেই যে, কেনো আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন ? আমাকে কেনো জন্ম দেয়া হলো ? কেনো তিনি আমাকে জীবন দান করলেন ? তিনি আপনাকে এই ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যও দায়বদ্ধ নন। তিনি أَحَدْ তাঁর সম্পর্কে এরকম ধারণা করবেন না যে, তিনি আপনার কাছে কোনোভাবে দায়বদ্ধ। তিনি যাই দিয়েছেন, সবই উপহার। সবকিছু। قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ    

- সূরা ইখলাসের আলোচনা থেকে 
- বায়্যিনাহ টিভি

কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.