নিজের দাম (১ম পর্ব)

নিজের দাম - ১

আজকের খুৎবায় আমি আপনাদের সাথে এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাঠ শেয়ার করতে চাই যা আমার বারবার স্মরণে আনা দরকার এবং আমি বিশ্বাস করি আপনাদেরও দরকার। আদম (আ) এর ঘটনায় আল্লাহ যা তুলে ধরেছেন সেখান থেকে। বিশেষ করে ইবলিশের কিছু ব্যাপার আজ আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। 
সাধারণভাবে সবাই জানে আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা আদম (আ) কে সৃষ্টি করেন। সৃষ্টি করার পর তিনি আদমকে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদের আদেশ করেন। সবাই এটা মেনে নিয়েছিল কিন্তু ইবলিশ অমান্য করেছিল। এটাই ঘটনার সহজ একটি বিবরণ। অধিকাংশ মানুষ এর সাথে পরিচিত। 
কিন্তু, কুরআনে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিস্তারিত বিবরণও এসেছে যা বাদ পড়ে যায়, যখন আপনি ঘটনাটি নিয়ে এভাবে সংক্ষেপে চিন্তা করেন। 
 
আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা সর্বপ্রথম সকল ফেরেশতাদের প্রতি ঘোষণা জারি করেন, আর আমরা বুঝতে পারি সেসময় তাদের মাঝে ইবলিশও এ ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ (ইন্নি খা-লিকুন বাশারাম মিন তীন)- "আমি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি মাটি থেকে বা কাদা থেকে। " [৩৮:৭১] 
আল্লাহ যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন তখনো তিনি আদমকে সৃষ্টি করেননি। আদম (আ) কে এখনো সৃষ্টি করা হয়নি কিন্তু ঘোষণা জারি করা হয়েছে যে, আল্লাহ এটা করতে যাচ্ছেন। এটা হলো খালিকুন বাশারাম মিন তীন। এরপর 'ফা ইজা'। আরবিতে 'ইজা' ব্যবহৃত হয় ভবিষ্যতে ঘটতে যাচ্ছে এমন কিছু বুঝাতে। فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ - (ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু ওয়া নাফাখতু ফিইহি মির রুউহি) "তাকে যখন আমি ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলবো এবং তার ভিতরে আমার রূহ ফুঁকে দেব..."  
এগুলোর কোনো কিছুই এখনো ঘটেনি। সামনে ঘটতে যাচ্ছে। এরপর তিনি বললেন- فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِیۡنَ- (ফাকা'য়ু লাহু ছা-জিদিইন) "তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও"। 
অনেক বছর আগে একজন প্রখ্যাত আলেমের সাথে আমার 'লাম' নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমি অবাক হয়েছি যে, কয়েক মাস আগে তিনি আমার কথার সাথে একমত হয়েছেন। এটা নিয়ে একটু পরে কথা বলবো। কিন্তু, সবার আগে আমি চাই আপনারা এই আলোচনার প্রথম অংশের প্রতি মনোনিবেশ করুন। 
আল্লাহ বর্ণনা করছেন তিনি আমাদের পিতাকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন এবং আমাদের সৃষ্টি করার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে যাচ্ছেন তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে আমি তাকে 'তীন' থেকে তৈরি করবো। 
চলুন, এখানে একটু থামি। এই পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র সৃষ্টি নই যাদের 'তীন' থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। বস্তুত, সকল প্রাণিকুল তথা যত ধরণের প্রজাতি এই পৃথিবীতে বর্তমান আছে তার সবই 'তীন' থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের এবং এই গ্রহে অবশিষ্ট অন্য সকল জীবের মাঝে এটা একটা কমন উপাদান। সমগ্র প্রাণী জগত, সকল পোকামাকড় সবাই 'তীন' থেকে এসেছে। আচ্ছা, বুঝলাম। 
কিন্তু, আল্লাহ এখন যাকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তার মাঝে অতিরিক্ত কিছু ব্যাপারও রয়েছে। আমাদের পিতার মাঝে এবং এর সাথে আমাদের মাঝেও। এই সৃষ্টিটি 'তীন' ছাড়াও আরও কিছু। তার মাঝে পাশবিক দিকের অস্তিত্ব ছাড়াও আরও কিছু আছে। 
প্রসঙ্গত, আমাদের এবং পশুদের মাঝে কমন কিছু ব্যাপার রয়েছে। পশু খাদ্য সন্ধান করে এবং আশ্রয় খোঁজে। আমরা খাদ্য কেনার জন্য মুদি দোকানে যাই। আমরা রেস্টুরেন্টে যাই খাদ্যের সন্ধানে। আমরা আশ্রয়ও খুঁজি। মূলত, এ দুইটা প্রধান কারণেই আমরা পড়ালেখা শিখি, চাকরি খুঁজি বা ব্যবসা শুরু করি। দিনশেষে, এগুলোর মূল প্রেরণা হলো খাদ্য এবং বাসস্থান। ফ্রিজে খাবার আছে তো? যে বাড়িতে বাস করছেন তা বসবাস করার জায়গা হিসেবে ঠিক আছে তো? বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছি তো? কলে পানি আছে তো? 
আমি যা বলতে চাচ্ছি- খাদ্য সংগ্রহ এবং বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা অন্যান্য প্রাণী জগতের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। কিন্তু, দিনশেষে এগুলো একই ধরণের মৌলিক কাজ। তারাও জন্ম দান করে। তাদেরও বাচ্চা-কাচ্চা আছে। তাদের প্রজাতিও প্রজন্মান্তরে চলতে থাকে। মানব জাতিও একই কাজ করে। 
তো, এ অর্থে...জীবন চালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টিতে আমরা আসলে প্রাণী জগত থেকে অতটা আলাদা কিছু নই। আমরা বাড়ি নির্মাণ করি। পাখি বাসা বানায়। আমরা রিজিকের সন্ধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। পাখিও তার রিজিকের সন্ধানতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। 
এরপর আল্লাহ আরও যোগ করলেন- কেন কাদা থেকে নির্মিত এই সৃষ্টি পৃথিবীতে বর্তমান থাকা অন্য সকল সৃষ্টি থেকে আলাদা? فَاِذَا سَوَّیۡتُهٗ (ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু)- যখন আমি তাকে সুষম করে তৈরি করবো বা ভারসাম্যপূর্ণ করবো। "تسويات" মানে কোনো কারূশিল্পকে নিখুঁত করা, ভারসাম্যপূর্ণ করা। উদাহরণস্বরূপ- কেউ যদি লোহা বা কোনো ধাতু গলিয়ে জোড়া লাগায়, সে তখন নিশ্চিত করতে চায় যেন উভয় অংশ একেবারে সমানভাবে জোড়া লাগে। তার কাছে জোড়াটাকে নিখুঁতভাবে সমান করার বিভিন্ন যন্ত্র থাকে। একে বলে تسويات  
তো, আল্লাহ বলছেন- এক ধরণের ভারসাম্য এবং পারফেকশন এই সৃষ্টির মাঝে যোগ করা হবে যা অন্য সৃষ্টির মাঝে নেই। 
এক দৃষ্টিতে বলতে গেলে- অন্য অনেক সৃষ্টির মাঝে আমাদের চেয়েও বেশি ভারসাম্য রয়েছে। বানর এক হাত ব্যবহার করেই ঝুলে থাকতে পারে। তাদের খুব ভালো ব্যালেন্স রয়েছে। পাখিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন ভঙ্গিতে উড়তে পারে। তো, এখানে আমাদের দুইপায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্যের চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। 
আল্লাহ এখানে বলছেন- মানবজাতির পরস্পর সাংঘর্ষিক বিষয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং পারিবারিক প্রয়োজনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য থাকবে তাদের। তারা ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব এবং সামাজিক দায়-দায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। তারা তাদের অধিকার এবং দায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করবে। আমাদের সমগ্র জীবনটাই হবে আসলে ভারসাম্যের সমষ্টি। 
বর্তমানে মাল্টি মিলিয়ন ডলারের এমন সব প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে ভারসাম্য শিক্ষা দেওয়া হয়। সফল মানুষেরা, সফল ব্যবসায়ীরা, বড় বড় কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা চাকরি জীবনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা শিখতে এসব সেমিনারে যোগ দেয়। তাই না? ব্যাল্যান্স অর্জন করতে।   
আল্লাহ বলছেন এই মানুষের এমনভাবে জীবন যাপন করার সামর্থ্য থাকবে, যে জীবন হবে সবদিক থেকে সমান, ভারসাম্যপূর্ণ। আল্লাহ বর্ণনা করছেন ভারসাম্য রক্ষা করার এই গুণটি মানুষের অন্যতম একটি মহৎ গুণ হবে। যা তাকে বিস্ময়কর করে তুলবে।  
তাহলে, প্রথমত তিনি মানুষকে অন্য সব প্রাণীর মত করে সৃষ্টি করেছেন। তারপর এই মানুষের সবকিছুর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করার চমকপ্রদ এক গুণ থাকবে। এরপর তিনি বলেন, এ সবকিছুর উপরে وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ -  
প্রসঙ্গত, সামনে আরও এগিয়ে যাওয়ার পূর্বে ভারসাম্য নিয়ে আরেকটি কথা বলতে চাই। ভারসাম্য হলো আমাদের আবেগ-অনুভূতি এবং চিন্তাশক্তির মাঝে। এর মানে কী? চলুন, একটু ব্যাখ্যা করি। ক্ষুধার্ত কুকুর সামনে কোনো খাবার দেখলে এর প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কামড় দিয়ে বসে। সে ফলাফল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না। এখানে আছে শুধু অন্তরের ইচ্ছা এবং কর্ম। আর কিছু না। 
কিন্তু মানুষ লোভনীয় কিছু একটার দিকে তাকিয়ে বলতে পারে:
"না, এটা অবৈধ।"
"না, ঐটা হারাম।" 
"না, এটা করা যাবে না।" 
তার বিবেক-বুদ্ধি কর্মতৎপর হয়ে উঠে। সে ফলাফলের কথা ভেবে থেমে যেতে পারে। গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, ইতোমধ্যে দেরি করে ফেলেছেন। এখন আবার রাস্তায় লাল বাতি। এমন সময়েও ভারসাম্য রক্ষা করার সামর্থ্য আপনার আছে। তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়ার আগ্রহ যেমন আছে, ঠিক তেমনি আইন মেনে চলার বুঝও আপনার আছে। আমরা আমাদের চিন্তা এবং আবেগের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারি। অন্য সৃষ্টির মত নয়, যারা কোনো একটা আবেগ জাগ্রত হলেই তা পূর্ণ করার জন্য ঝাঁপিয় পড়ে। তারা প্রতিক্রিয়া দেখায়। 
কিন্তু, আমরা ফলাফল নিয়ে ভাবতে পারি, দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে পারি। আমরা নিজেদের থামিয়ে দিতে পারি। কুরআনে আমাদের বুদ্ধির নামও ঠিক এভাবে এসেছে। 'আল-হিজর', 'আন-নুহা'। আমাদের বুদ্ধির বর্ণনা দিতে এ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। 'হিজর' মানে শিলা, পাথর। কারণ, পাথর সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। আর 'নুহা' মানে প্রতিনিষেধ। কারণ, আমাদের বুদ্ধি আমাদেরকে বোকার মত কিছু করতে বাধা দান করে। এটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। 


 
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন   

কোন মন্তব্য নেই

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.