একটি আদর্শ উপশাখার বৈশিষ্ট্য ও পরিচালকের গুনাবলী
একটি আদর্শ উপশাখার বৈশিষ্ট্য ও পরিচালকের গুনাবলী
উপশাখার সংজ্ঞাকেন্দ্রীয় সংগঠনের শাখাসমূহের আওতায় সারা দেশের সংগঠনকে যে ছোট ছোট ক্ষুদ্রতম কর্মক্ষেত্রের আকারে বিভক্ত করা হয় তাই উপশাখা। প্রতি উপশাখায় একজন দায়িত্বশীলসহ কমপক্ষে তিনজন কর্মী থাকে যারা কতিপয় নির্ধারিত মৌলিক কর্ম নিয়মিত সম্পাদনে সক্রিয় থাকেন।
উপশাখার পরিচয়
সংগঠন স্বীকৃত প্রাথমিক ইউনিট।
সংগঠনের বুনিয়াদি কাজের প্রাথমিক স্তর
উপশাখা হচ্ছে কাজের Practical Field
উপশাখা হচ্ছে- Recruiting Center, Supply Center, Production Center, One kind of industry
উপশাখার ১টি উদাহরণ হচ্ছে- রশি, জাল ও সীসাসংবলিত ১টি মাছ শিকারের জালের মত। রশি জাল যতই মজবুত হোক না কেন সীসা না থাকলে মাছ শিকার করা যায় না, অনুরূপভাবে আপাতদৃষ্টিতে সব ঠিক আছে মনে হলেও সীসাসম উপশাখা কার্যক্রম যথাযথ না থাকলে সংগঠন দুর্বলই থেকে যায়। আদর্শ সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মজবুত উপশাখা। উপশাখার Product কে Purify ও Modify করে থানা, জেলা তথা ঊর্ধ্বতন সংগঠন। অর্থাৎ একটি উপশাখার দায়িত্বশীল, কর্মী ভাইদের সাংগঠনিক ও দাওয়াতি তৎপরতার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার সকল শ্রেণী ও পেশার জনমানুষের মধ্যে সংগঠন সম্পর্কে যে ধারণার জন্ম নেয় তার ভিত্তিতেই তারা গোটা সংগঠনকে মূল্যায়ন করে। তাই বলা যায় উপশাখা হচ্ছে সংগঠনের দর্পণ।
উপশাখার গুরুত্ব
১. উপশাখাসমূহ সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে।
২. রিক্রুটিং সেন্টার হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
৩. নির্দিষ্টমান পর্যন্ত লোক তৈরি হয় উপশাখার মাধ্যমে।
৪. প্রচুর সংখ্যক সমর্থক উপশাখার সাথে জড়িত থাকে।
৫. দাওয়াতি কাজের আসল ক্ষেত্র।
৬. নেতৃত্ব তৈরির প্রাথমিক স্তর।
৭. মৌলিক কাজের অনেকাংশ উপশাখা সম্পাদন করে থাকে।
৮. উপশাখাকেন্দ্রিক এলাকা ইধংব ধৎবধ হিসেবে গড়ে ওঠে।
৯. মজবুত উপশাখার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মজবুত সংগঠন। আজকে যেমন উপশাখা আগামী দিনে তেমন সংগঠন সব ধরনের বাধা বিপত্তির আওতামুক্ত অর্থাৎ- যে সকল কারণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাতিল বা বাধাগ্রস্ত হয় সে রকম কোনো পরিস্থিতি উপশাখা পর্যায়ে হওয়া সম্ভব নয়।
১০. কেন্দ্রে কোনো কাজ না হলেও কোনো অসুবিধা নেই যদি উপশাখার কাজগুলো সুচারুরূপে হয়, কিন্তু উপশাখায় কাজ না হলে এক পর্যায়ে সংগঠনই ভেঙে পড়বে।
১১. উপশাখা যে রকম জনশক্তি সংগ্রহ করবে সংগঠন সে রকম নেতৃত্ব পাবে।
১২. কোনো নির্ধারিত অফিস ছাড়াই প্রোগ্রামসমূহ বাস্তবায়ন করা যায়। উপশাখার কুরআন তালিম, সামষ্টিক পাঠ ইত্যাদি প্রোগ্রামসমূহ ক্লাসরুমে, নামাজের আগে পরে মসজিদে, খেলার মাঠে এমনকি নৌকা বা গাড়িতে বসেও করে নেয়া যায়।
১৩. আল্লাহ না করুন যদি আমাদের থানা সভাপতি থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কোনো দায়িত্বশীল কাজ করতে না পারেন তাতে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে যদি আমাদের উপশাখাগুলোর সামষ্টিক পাঠ, কুরআন তালিম, কর্মী বৈঠক বন্ধ হয়ে যায়।
উপশাখা গঠনের পূর্বশর্ত কী কী?
একটি নতুন উপশাখা গঠন করতে হলে অথবা সমর্থক শাখা উপশাখায় উন্নীত করতে হলে অবশ্যই নিম্নোক্ত মৌলিক শর্তগুলো পূরণ করতে হয়-
১. জনশক্তি : কমপক্ষে কর্মী- ৫ জন, সমর্থক- ১০ জন, বন্ধু- ১২ জন ও শুভাকাক্সক্ষী- ৫ জন।
২. পাঠাগার : কমপক্ষে আল কুরআন ৫টি (খণ্ড), আল হাদিস ৫টি, ইসলামী সাহিত্য ১৫টি সিলেবাসভিত্তিক।
৩. ফাইল : রিপোর্ট সংরক্ষণ ফাইল ১টি, প্রকাশনা সংরক্ষণ ফাইল ১টি ও ফরম সংরক্ষণ ফাইল ১টি।
৪. খাতা : প্রোগ্রাম খাতা ১টি, বায়তুলমাল রেজিস্টার ও আদায়ের খাতা ১টি, জনশক্তি, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষী রেজিস্টার খাতা ১টি এবং পাঠাগারের বই রেজিস্টার ও বিলির খাতা ১টি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র প্রকাশিত ১টি খাতা ব্যবহার করা যথেষ্ট।
৫. ঊর্র্ধ্বতন সংগঠনের অনুমোদন।
আদর্শ উপশাখা
১. উপশাখার কাজসমূহ নিয়মিত হওয়া।
২. নিয়মিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও রিপোর্টিং।
৩. প্রত্যেক দফাভিত্তিক কাজ হবে।
৪. পরবর্তী দায়িত্বশীল থাকবে।
৫. উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মীর ব্যাচ থাকবে।
৬. ঊর্ধ্বতন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
৭. নিয়মিত বৃদ্ধি পাবে (সাথী, কর্মী, সমর্থক ও সুধী)
৮. উল্লেখযোগ্য হারে বায়তুলমাল আদায় হবে।
৯. পাঠাগার সচল থাকবে।
আদর্শ উপশাখার মৌলিক বৈশিষ্ট্য
বৃদ্ধি সংক্রান্ত
ক) প্রতি মাসে কমপক্ষে কর্মী বৃদ্ধি ২ জন, সমর্থক বৃদ্ধি ৪ জন, বন্ধু বৃদ্ধি ৬ জন ও শুভাকাক্সক্ষী বৃদ্ধি ২ জন করা ।
খ) প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫টি কিশোরকণ্ঠ, ২টি ইয়ুথ ওয়েভ ও ৩টি ছাত্র সংবাদের গ্রাহক বৃদ্ধি করা।
গ) প্রত্যেক কর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে বছরে কমপক্ষে ১ জন কর্মী, ৫ জন সমর্থক এবং প্রত্যেক সাথী ১ জন সাথী, ১ জন কর্মী ও ১০ জন সমর্থক বৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন।
প্রোগ্রাম সংক্রান্ত
ক) মাসের প্রথম দিকে প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রাম ১টি (সামষ্টিক পাঠ, কুরআন তালিম)
খ) মাসের মাঝামাঝিতে দাওয়াতি প্রোগ্রাম ১টি (সাধারণ সভা, চা-চক্র, সাধারণ জ্ঞানের আসর ইত্যাদি)।
গ) মাসের শেষের দিকে কর্মী বৈঠক ১টি, মাসের যে কোনো সময় গ্র“প দাওয়াতি কাজ কমপক্ষে একবার। এ ছাড়া, প্রতি সোমবার দাওয়াতি বার। এক্ষেত্রে দাওয়াতের বিষয়ে আমাদের কমন শ্লোগান হচ্ছে “দাওয়াত হবে সমসময়, সবখানে” সে ক্ষেত্রে দাওয়াতের বিশেষ Motivation এর অংশ হিসেবে প্রত্যেক সোমবারকে দাওয়াতি বার হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
বায়তুলমাল সংক্রান্ত
ক) জনশক্তি, সমর্থক, ও শুভাকাক্সক্ষীদের প্রতি মাসে নতুন এয়ানত বৃদ্ধি করা।
খ) জনশক্তি শুভকাক্সক্ষী সংখ্যার ১০০% ও সমর্থক সংখ্যার ৯০% আদায় নিশ্চিত করা।
গ) প্রতি মাসে ১টি টেবিল ব্যাংক, ১টি দোকান বক্স, ১টি হাঁড়ি বৃদ্ধি করা।
পাঠাগার সংক্রান্ত
ক) পাঠাগার থেকে প্রত্যেক জনশক্তি প্রতি মাসে কমপক্ষে ১টি কুরআন, ১টি হাদিস ও ১টি ইসলামী সাহিত্য ইস্যু করে নেয়া এবং পড়া।
খ) প্রতি মাসে পাঠাগারে কমপক্ষে ১টি কুরআন, ১টি হাদিস ও ২টি ইসলামী সাহিত্য বৃদ্ধি করা।
উপশাখা সভাপতি সাথী হওয়া এবং সেক্রেটারি সাথী প্রার্থী হওয়া আবশ্যক।
আদর্শ উপশাখা পরিচালনায় পরিচালকের গুণাবলি
জ্ঞান ও আমলের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন।
কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সবচাইতে আস্থাভাজন ব্যক্তি।
সবচাইতে বেশি ধৈর্যশীল।
সাহসিকতাপূর্ণ।
জরুরি পরিস্থিতিতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী।
ভ্রাতৃত্ব ও প্রেরণা সৃষ্টির যোগ্যতা।
ত্যাগের ক্ষেত্রে অগ্রগামী।
কর্মীদের সাথে সমান ব্যবহার ও ইনসাফ কায়েম।
সুবক্তা।
নথিপত্র ও হিসাব সংরক্ষণে পারদর্শী।
পরিচালকের মৌলিক দায়িত্ব
১. সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণ।
২. যোগ্যতার আলোকে কর্মবণ্টন।
৩. উপযুক্ত তত্ত্বাবধান।
৪. প্রোগ্রাম পরিচালনা।
৫. সংবাদ আদান প্রদান।
৬. রিপোর্টিং ও পর্যালোচনা।
আদর্শ দায়িত্বশীলের ভূমিকা কী?
উপশাখার এরিয়া সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান ।
পঞ্চম শ্রেণী-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের সব ছাত্র সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ। এ ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্র, স্থানীয় প্রভাবশালী ছাত্র, অমুসলিম ছাত্র ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের পৃথক পৃথক তালিকা সংগ্রহ করা।
ঊর্ধ্বতন সংগঠনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ও গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করা।
সব জনশক্তিকে সক্রিয় রাখতে এবং ক্রমান্বয়ে মানোন্নয়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
সর্বস্তরে বৃদ্ধির দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।
উপশাখার প্রোগ্রামসমূহ বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
বায়তুলমালের এয়ানত আদায় বৃদ্ধির ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
সব জনশক্তির পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা, বই বিলি এবং নতুন বই সংগ্রহ করা।
আসর থেকে মাগরিবে পাড়ায় ও খেলার মাঠে ভূমিকা পালন করা। এক্ষেত্রে উপকরণসহ এক মসজিদে আসরের নামাজ, অন্য মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায়।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মোতাওয়াল্লিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা।
সমাজের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকা সংগ্রহ করে শুভাকাক্সক্ষী বানানোর চেষ্টা করা। অন্তত সুসম্পর্কের ফলে যদি বিরোধিতা কমে যায়।
গরিব অসহায় ছাত্রদের পড়ানো, শিক্ষা উপকরণ প্রদান ও আর্থিক সহযোগিতার প্রচেষ্টা চালানো।
স্মরণীয় ও আনন্দ দিবসগুলোতে বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করা।
মাসিক দায়িত্বশীল বৈঠকে প্রয়োজনীয় রিপোর্টসহ যথাসময়ে উপস্থিত থাকা।
জাতীয়, ইসলামী ও সাংগঠনিক দিবসসমূহ পালন ও সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা।
সকল পর্যায়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করা।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আপসহীন হওয়া ও আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।
শেষ কথা
একটি সংগঠনকে তখনই আদর্শ সংগঠন বলা যায়, যখন ওই সংগঠনটির উপশাখা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রত্যেকটি অঙ্গ সচল থাকে। যার ফলে পুরো সংগঠনটি একটি মেশিনের মত ভূমিকা পালন করবে। যেখানে পরিচালকের পরিকল্পনা ও ইচ্ছামাফিক প্রয়োজনীয় ফলাফল অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু যদি একটি মেশিনের বড় বড় পার্টসগুলো সচল থাকে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলো কাজ না করে তাহলে যেমনি মেশিনের প্যাডেলঘুরিয়ে ক্লান্ত হওয়া যাবে, ইঞ্জিনটি দিয়ে কাজ হাসিল তো দূরের কথা চালুই করা যাবে না। তেমনি সংগঠনের শুধু উপরের অংশ সচল থাকলে আর প্রাথমিক স্তর তথা উপশাখাসমূহ অচল হলে, কিছু সময় পর্যন্ত তৎপর থাকা যাবে- এরপর আর হালে পানি মিলবে না। এ জন্য পরিস্থিতি যাই হোক আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক স্তর উপশাখাকে সক্রিয় থাকতে হবে এবং সক্রিয় রাখতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে শহীদদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়ার তৌফিক দিন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই